বরকতের মাস রমজান। ইবাদতের এ বসন্তে বান্দার প্রতি আল্লাহর আল্লাদ বেশিই থাকে। যেকোনো ইবাদতেই অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সওয়াব দিয়ে থাকেন। বান্দার ইবাদতের পথও সহজ করেন। এ মাসে শয়তানকে ওয়াসওয়াসা প্রদান থেকে বিরত রাখা হয়। ইবাদতে উৎসাহিত করার জন্য বান্দাকে নানা উপায়ে প্রলুব্ধ করা হয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমজান এলে আল্লাহ আকাশের দরজা খুলে দেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। শয়তানকে শেকলবদ্ধ করে রাখেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নম্বর ১৮৯৮, ১৮৯৯, ৩২৭২ সহিহ মুসলিম ১০৭৯) অপর বর্ণনায় এসেছে, রমজানের শুরুর রাতেই শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শেকলবন্দী করা হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর আর খোলা হয় না। এছাড়া জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। রমজানের শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ করা হয় না। এক অদৃশ্য ঘোষক ডাকতে থাকে, হে কল্যাণ প্রত্যাশী, তুমি কল্যাণের দিকে ধাবিত হও। আর হে অনিষ্টের ধ্বজাধারী, অন্যায় থেকে বিরত থাকো। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রমজানের প্রতি রাতেই আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে অনেক মানুষকে মুক্তি দেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নম্বর ৬৮২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৬৪২)
রমজান মাসে আল্লাহর রহমত লাভের সুযোগ থাকে অবারিত। তাই মাসের শুরু থেকেই বিশেষ আমলের প্রতি যত্নশীল থাকা উচিৎ।
রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ইহতিসাব। ইহতিসাব হাদিসের পরিভাষা। এর অর্থ হলো, সওয়াবের নিয়ত রাখা। অর্থাৎ রমজানের রোজা সওয়াবের নিয়তে রাখতে হবে। এর বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের দাবিতে এবং সওয়াবের নিয়তে রোজা রাখবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নম্বর ৩৫, ৩৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৭৫৯, ৭৬০)
রমজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল সেহরি খাওয়া। অনেকেই শুরুর রাতে অধিক খেয়ে থাকেন। পরে চাহিদা না থাকায় শেষ রাতে না খেয়েই রোজা রাখেন। এটি ঠিক নয়। সেহরি অল্প হলেও খাওয়া চাই। কারণ, সেহরিতে রয়েছে অবারিত বরকত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেহরি খেতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা সেহরি খাও। সেহরিতে বরকত রয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ১৯২৩, সহিহ মুসলিম ১০৯৫)
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। তাই এ মাসের আমলে থাকতে পারে কোরআন তেলাওয়াতের সবিশেষ গুরুত্ব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, আয় আল্লাহ, এই ব্যক্তি আমার জন্য দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থেকেছে, তাই আপনি তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করেন। অপরদিকে কোরআন বলবে, হে আল্লাহ, এই ব্যক্তি রাত্রিজেগে কোরআন পড়েছে, তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। (সুনানে বাইহাকি, হাদিস নম্বর ১৮৩৯)
রমজানে বান্দার প্রতি আল্লাহ অধিক সদয় থাকেন। তাই জীবনের গুনাহখাতা মাফ করিয়ে নেয়ার শ্রেষ্ঠ সময় রমজান। এজন্য রমজানে বেশি বেশি তাওবা করা উচিৎ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার নাক ভূলুণ্ঠিত হোক যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু সে আমার ওপর দুরুদ পাঠ করেনি। ভূলুণ্ঠিত হোক তার নাক যার কাছে রমজান মাস এলো অথচ তার গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার পূর্বেই তা পার হয়ে গেল। আর ভূলুণ্ঠিত হোক তার নাক যার নিকট তার মা-বাবা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলো, কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করায়নি (সে তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে জান্নাত অর্জন করেনি)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)
রোজার মহত্ব ক্ষুণ্ণ করে মিথ্যা। তাই রমজানে মিথ্যা পরিহারে আরো সচেতন থাকতে হবে। মিথ্যা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে হবে। রমজানের দিবসে মিথ্যাচারে আল্লাহ অধিক রুষ্ট হন। হাদিসের ভাষ্য দেখুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে মিথ্যাকে পরিহার করে না এবং মিথ্যাকে আমলে নেয় না, জাহাল এড়িয়ে চলে না, তার পানাহার পরিহারে আল্লাহর কোনো আগ্রহ নেই। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ৬০৫৭)
রমজানে দান-দক্ষিণার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ মাসের দানের ফজিলত বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এ মাসের দান-সদকার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন। হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাপেক্ষা বেশি দানশীল ছিলেন। তাঁর দানশীলতা বহু গুণ বর্ধিত হতো রমজানের পবিত্র দিনে, যখন জিবরাইল আ. তাঁর সাথে দেখা করতেন। জিবরাইল আ. রমজানের প্রতি রাতে তাঁর সাথে দেখা করে কোরআন শুনতেন ও শোনাতেন। নবী (সা.) কল্যাণ বণ্টনে (দান-সদকায়) প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল ছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৫৫৪)
রমজানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হলো দোয়া করা। এ মাসে হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো আমরা পড়তে পারি। আমাদের মুনাজাতে সেগুলোর আলোকেও আল্লাহর কাছে চাইতে পারি। একটি বিশেষ দোয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, আয়েশা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি লায়লাতুল কদর পাই, তাহলে আমি তখন কী দোয়া করবো। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তখন তুমি বললে,
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ كريم تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আপনি ক্ষমাকে ভালোবাসেন। তাই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ হাদিস নম্বর ২৫৩৮৪, সুনানে তিরমিজি হাদিস নম্বর ৩৫১৩ সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নম্বর ৩৮৫০)
এ মাসে দিনে যেমন রোজা রাখতে হয়, রাতেও কিয়ামুল লাইলের গুরুত্ব দিতে হয়। নানা হাদিসে তা বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করে বেশি বেশি নেক আমল করার তাওফিক দান করেন। আমিন।