Search

এই বিভাগের আরো খবর

সারা বছরই লাভজনক সবজি চাষ পদ্ধতি

দেশপ্রান্তর:

সবজি উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ সবজি ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব।

সবজি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় সবজিকে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল (ঐড়ৎঃরপঁষঃঁৎধষ পৎড়ঢ়ং) বলা হয়ে থাকে। পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি ফসল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি। আর আধুনিক কলাকৌশল বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদকেই বোঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সারা দেশে যেমন সব ধরনের সবজি উৎপাদিত হয় না ঠিক তেমনি সব সবজিই আবার সারাবছর উৎপাদিত হয় না। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। আবার বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ সবজির জাত উৎপাদন করা যায়।

সারা দেশে সারাবছরই যেসব সবজি সহজে উৎপাদিত হয়ে থাকে তাদের কিছু শাকসবজির কথা এখানে তুলে ধরছি। লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক, মিষ্টিআলু শাক, ঢেঁড়স, গাজর, বরবটি, টমেটো, লাউ ও লাউশাক, পাটশাক, শসা, কাঁচকলা, বেগুন, পেঁপে, করলা, কচুশাক, কচুর লতি, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি পরিচিত শাকসবজি। তাছাড়া অপরিচিত বিশেষ কিছু সবজি বিশেষ বিশেষ এলাকার বিশেষত্ব হিসেবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। উপরোক্ত ফসলগুলোর মধ্যে কিছু শাক আর বাকিগুলো শাক এবং সবজি উভয় হিসেবেই প্রচলিত রয়েছে।

কৃষিতাত্ত্বিকভাবে রবি (শীতকাল) ও খরিপ (গ্রীষ্মকাল)- এ দুই ধরনের মৌসুম রয়েছে। খরিপের আবার দুটি ভাগ, যথা- খরিপ-১ (আগাম গ্রীষ্ম) এবং খরিপ-২ (বর্ষাকাল)। তবে শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে বাহারি ও রকমারি বৈচিত্র্য একটু বেশি। শুধু শীতকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলগুলোর মধ্যে রয়েছে- টমেটো, শীতলাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শিম, মুলা, ব্রকলি, বাটিশাক, ওলকপি, শালগম, বেগুন, গোলআলু ইত্যাদিই প্রধান। অন্যদিকে শুধু গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে উৎপাদিত হয় এমন ফসলের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের কচু, ওলকচু, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, কাকরোল, পটোল, করলা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া ইত্যাদিই প্রধান।

সবজি উৎপাদন অন্যান্য ফসলের মতো নয়। সবজি উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের যত্নের প্রয়োজন হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ করতে গেলে অল্প পরিমাণ জায়গায় অধিক পরিমাণ সবজি ফলিয়ে লাভবান হওয়া সম্ভব।

সেজন্য সবজি আবাদের জন্য বাড়ির আঙিনায় অথবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা বেছে নিতে হবে। সেখানে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমির মাটি জো অবস্থায় ঝুরঝুরে করে সেখানে এক মিটার প্রশস্ত এবং প্রয়োজনমতো জমির আকার-আকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লম্বা বেড তৈরি করে নিতে হবে। প্রতিটি বেডের মাঝখানে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত করে নালা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ নালার মাটি তুলেই দুইপাশে বেড প্রয়োজনমতো উঁচু করতে হবে।

এভাবে বেড তৈরির একটি বিশেষত্ব হলো আমি আগেই বলেছি, শাকসবজি চাষাবাদ অন্য সাধারণ ফসল আবাদের চেয়ে একটু ভিন্ন। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা ও যত্নের। শাকসবজির চাষাবাদে যেমন শুষ্ক মৌসুমে সেচের চাহিদা থাকে অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি বের করে দেয়ার প্রয়োজন হয়। সেজন্যই বেড তৈরি করে মাটি কিছুটা উঁচু করা হয় সেখানে আবার নালা তৈরি করে নিষ্কাষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়। কিন্তু বেড এবং নালা তৈরি না করলে সেটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আবাদ হয় না। সেটা হয় সাধারণ শাকসবজি চাষ। এতে ফলন অনেক কমে যায়।

পেঁপে, কাঁচকলা- এজাতীয় সবজি বসতবাড়ির আঙিনায়, রাস্তা বা পুকুরের ধারে সহজেই আবাদ করা যায়। লালশাক, ডাঁটাশাক, পাটশাক, মুলাশাক, গাজর, শালগম ইত্যাদি সবজি তৈরিকৃত বেডে ছিটিয়ে বীজ বুনে দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ঢেঁড়স, কচু, ওলকচু ইত্যাদি সবজি এক মিটারের বেডে দুই সারি করে নির্ধারিত দূরত্বে চারা লাগিয়ে আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সেজন্য এসব সবজি উৎপাদনের জন্য আলাদাভাবে নার্সারিতে চারা তৈরি করে নিতে হয়। অন্যদিকে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শসা, চালকুমড়া, পটোল, কাকরোল, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শিম, বরবটি ইত্যাদি লতাজাতীয় সবজি চাষের জন্য ওই বেডে দুটি সারি করে সেখানে জাংলা দিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বেডের দুইপাশে খুঁটি দিয়ে পরে তা ইংরেজি অক্ষর ‘এক্স’ আকৃতিতে বা ‘ভি’ আকৃতিতে বাঁকিয়ে বেঁধে দিতে হয়।

বেড ছাড়াও লতাজাতীয় এসব সবজি অতি সহজেই ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে বিশেষ ব্যবস্থায় আবাদ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য যে কোনো ফসলের তুলনায় এসব সবজি ফসলের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। বিনা আবাদেই এসব সবজি চাষ করা যেতে পারে। সেজন্য বন্যা পরবর্তীতে পুনর্বাসনের সময় বিনাচাষে এসব আবাদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ জৈবভাবেই এসব সবজি ফসল উৎপাদন সম্ভব। আবাদের আগে সামান্য পরিমাণ প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে বাকিটা মেটাতে হবে বাড়িতে উৎপাদিত জৈব সারের মাধ্যমে। তারপর আন্তঃপরিচর্যা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতেও জৈবপদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। তখন এসব উৎপাদিত ফসল সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

কাজেই এভাবেই সারাবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বল্পপরিসরে শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের চাহিদা মিটিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের শারীরিক পুষ্টি চাহিদার একটি বিরাট অংশ শাকসবজি থেকে আসা দরকার। দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে কমপক্ষে আড়াইশ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। আর সেটা নিবিড়ভাবে এবং নিরাপদভাবে খেতে হলে নিজের উৎপাদিত শাকসবজি খাওয়াই সবচেয়ে উত্তম। কাজেই আমাদের সারাবছর অলস সময়টাকে কাজে লাগিয়ে আসুন নিজের বাড়ির আঙিনায় সবজির বাগান গড়ে তুলি।

ড. মো. হুমায়ুন কবীর: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »